৭ মার্চের একটি অলিখিত মহাকাব্য রিভিউ

৭ মার্চের ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধু ….

কোনো কোনো নেতার ভাষণ জাতির ইতিহাস পাল্টে দেয়। আব্রাহাম লিংকনের “গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস”(১৮৮৩), মার্টিন লুথার কিং এর “I have a Dream”(১৯৬৩)। কিন্তু কোন ভাষণ পারেনি একটা জাতিকে স্বাধীনতার সাধ এনে দিতে, পারেনি মুক্তির রাজটিকা ললাটে পরিয়ে দিতে….
শুধু একটি ভাষণ, একটি কাব্যই পেরেছে…. ১৯/১৮ মিনিটের ১১০৮ শব্দের সে কাব্যকে আমরা বলি ৭ই মার্চের ভাষণ….
যার স্রষ্ঠা- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

God sent him to make free the Bengalee nation… 
কিভাবে সম্ভব- লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়া, শরীরে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে মাথার উপর উড়ন্ত জঙ্গি বিমানের ভয় একপাশে রেখে এমন একটি ভাষণ দেওয়া….!!!!

সেদিন বঙ্গবন্ধু আসলেন, দেখলেন, বললেন, এবং
জয় করলেন ও করালেন…..
তার ভাষনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য দুর্দমনীয়
অনুপ্রেরণার ও স্বাধীনতাকামী প্রত্যেক জাতি,
প্রত্যেক মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যত সব সময়ের জন্য অনুপ্রেরণার চিরন্তন উৎস…. আজকের ফিলিস্তিনীর জন্য, আজকের বেলুচিস্তানবাসীর জন্য, আজকের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য,আজকের চেচনীয়াদের জন্য, আজকের
কাতালোনীয়বাসীদের জন্য…..

১. বঙ্গবন্ধু বাঙালির ন্যায্য অধিকারের চিরন্তন চাওয়া নিয়ে বক্তব্যটি শুরু করেছিলেন- “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়..”- আজ
বর্তমানে দাড়িয়ে একটু কান পেতে শুনুন তো- ফিলিস্তিনীরা কী চায়, বেলুচরা কী চায়, চেচনীয়
কী চায়, রোহিঙ্গারা কী চায়, কাতালোনীয়ানরা কী
চায়, কী বলে…. শুধু নিজের ন্যায্য অধিকার। তারা পায়নি, আমরা পেয়েছি। পার্থক্যটা একজন_বঙ্গবন্ধু….

২. ” আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে গড়ে তুলবো”— একটি দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এরচেয়ে যুতসই কথা কি হতে পারে…?

 ৩. বঙ্গবন্ধু বলেন- ” ২৩ বছরের করুন ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের,বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস…” — ইতিহাসের নির্মম দিকটি তুলে ধরলেন। এরপর বাঙালি জাতির
সংগ্রামের ধাপগুলো বলে গেলেন। ইতিহাসের সাথে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের সমন্বয়টা এর চেয়ে দারুণ হতে পারত কি..?

৪. বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টে আলেচনার কথা বলতে গিয়ে বলেন- “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, আমরা মেনে নেবো…”— এ কথাটি সংসদীয় গণতন্ত্রের চরম ও চিরন্তন সত্য। বর্তমান সময়ের বিশ্বের জন্য এটা একধরনের আপ্তবাক্যই। ওনার এই উক্তিটি এখনো পার্লামেন্টে আলোচনা কিভাবে করা উচিৎ সেটার জন্য একটি দিকপাল কথন… আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এই বাক্যটি খোদাই করে দেওয়া উচিৎ। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রত্যেক সাংসদ বুঝতে পারে পার্লামেন্টে কিভাবে আলোচনা করতে হয়, সহনশীলতার চর্চা করতে হয়।

৫. “শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে, আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না…”— কতটুকু শক্তিশালী কথা ভাবতে পারেন…? পিতা কি ছেলের রক্ত পাড়া দিয়ে আপোষ করতে পারে..? ভাই কি ভাইয়ের বা ভাই কি বোনের রক্ত……? সেটা ওনি করেননি বলেই বঙ্গবন্ধু…. তাই তিনি কারো ছিলেন পিতা, কারো জন্য মুজিব ভাই, আর কারো জন্য স্নেহের মুজিবর….

৬. “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের
মানুষের অধিকার চাই…”– একটু ভেবে দেখুন তো কতটুকু নির্লোভ হলে এটা বলা যায়…!! ওনি
প্রধানমন্ত্রীত্ব পায়ে ঠেলে, শুধু বাঙালির অধিকার
চেয়েছে…. বঙ্গবন্ধু কিছু চাননি, চেয়েছে অধিকার-
বাংলার কৃষকের, বাংলার শ্রমিকের, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের…. তাই বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন বাংলার মাঠিতে নেমে বলেছিলেন— রবিঠাকুর দেখে যান আমার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে……

৬. “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…”— স্বাধীনতা প্রস্তুতির কথা বলার জন্য এর চেয়ে কি দৃঢ় ও সুন্দরভাবে বলা যায়….? ভাবুনতো বেলুচিস্তান কেন এখনো পরাধীন…? বঙ্গবন্ধুর এককথায় বাঙালি তার ঘরকে বানিয়েছে দুর্গ, শরীরকে বানিয়েছে ঢাল, মনকে বানিয়েছে অস্ত্র….

৭. “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা সব বন্ধ করে দেবে…”— অনেকে বলেন ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা প্রচ্ছন্ন ঘোষনা ছিল। তবে আমার কাছে মনে হয়, প্রচ্ছন্ন নয়, সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল..

৮. ” গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না…” — বঙ্গবন্ধু হরতাল দিয়েছিলেন, তার মানে এই না যে হরতালে মানুষ মরুক, তবুও হরতাল আন্দোলন সফল হোক। মানুষের অধিকারের জন্য হরতাল, হরতালের
জন্য মানুষের অধিকারের বঞ্চনা নয় ; বিশেষত: গরীব- দুঃখী মানুষের। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলে গরীবের ‘মুজিব ভাই’

৮.”এই সাতদিনে হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পর মালিক তাদের বেতন পৌছে দেবেন…”— শ্রমিকের অধিকার আছে রাজনৈতিক আন্দোলনের, এরজন্য কোন মালিক যেন তার পেঠে লাতি না মারে….

৯. “এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের উপর…”  সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন আমরা বাঙালিকে স্পর্শ করতে না পারে তার জন্য তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এ বাণী আজকের বাংলাদেশের জন্য কতই না প্রযোজ্য? স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও কি আমরা ওনার সেই সতর্কবাণী আগ্রাহ্য করতে পারি…? আজ একজন মানুষ হিন্দু বলে মার খায়, সাওতাল বলে মার খায়…. একজন মানুষ ভিন্নমতের হলে তরবারি হাতে কতল করতে নেমে যায়…. সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বললে ড. জাফর ইকবাল স্যারের মতো মানুষের ঘাড়ে কোপ পড়ে…..

১০. “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”—- মাথার উপর জঙ্গি বিমান উড়ছে, আর নিচে একজন কবি লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে স্বাধীনতার, মুক্তির কবিতা বলছে। কতটুকু
ভয়ডরহীন ছিল মানুষটি…..!!! স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষনা এই পৃথিবীর ইতিহাসে এরচেয়ে তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে আর কেউ দেয়নি, দিতে পারবেও না এবং সম্ভবও নয়। এটা মহাপ্রলয়ের শেষ হুঙ্কার। যে প্রলয়ে প্রায় ২০০ বছরের সংগ্রামে পাওয়া জিন্নাহদের পাকিস্তান খড়কুটোর মত স্রেফ
উড়ে গেছে….

১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর অলিখিত এবং তাৎক্ষনিক তৈরি সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি পাঠকদের জন্য হুবহু প্রকাশ করা হলো :

"আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি- আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।

আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্ত দানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান দশ বছর আমাদের গোলাম করে রাখলো। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বলেলেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।

তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো-আমরা তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু ‘মেজরিটি’ পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে, তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন।

আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।

জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হলো। ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয়; আরো আলোচনা হবে। মওলানা নুরানী ও মুফতি মাহমুদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারি নেতারা এলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা হলো- উদ্দেশ্য ছিলো আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি ৬-দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ।

কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ‘ডবল জিম্মী’ হতে পারবেন না। পরিষদ কসাই খানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙে দেয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবে না।

তা সত্বেও পয়ত্রিশ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এলেন। কিন্ত পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেয়া হলো, বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে, বলা হলো আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু হয়নি।

এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলো।

কিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুখি জনতার উপর চলছে গুলি।

আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে-আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি ১০ই মার্চ তারিখে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি, তাঁর সাথে টেলিফোন আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি আপনি দেশের প্রেসিডেণ্ট, ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরীব জনসাধারণকে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে । 

আমি আগেই বলে দিয়েছি কোন গোলটেবিল বৈঠক হবে না। কিসের গোলটেবিল বৈঠক? কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা বোনের কোল শূন্য করেছে তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে ? তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহবান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন।

হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো- কিন্তু গুলী করে মারা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলী খাই, দোষ আমাদের- আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের।

ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্ত আমার দাবী সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসনো না। এ দাবী মানার আগে পরিষদে বসার কোন প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাব না।

ভাইয়েরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, মানুষের অধিকার চাই। প্রধান মন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি, ফাঁসীর কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো; মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।

আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারী, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ অনির্দিষ্ট-কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে।

ট্রেন চলবে- তবে সেনাবাহিনী আনা-নেয়া করা যাবে না। করলে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।

সেক্রেটারীয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট জজকোর্ট সহ সরকারী, আধা-সরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের ব্যাঙ্কগুলো দু-ঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবেন না। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে। তবে, সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।

এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। যদি একটিও গুলী চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো-পানিতে মারবো। হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবেনা। গুলী চালালে আর ভাল হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবীয়ে রাখতে পারবা না। বাঙ্গালী মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। শহীদদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন।

সাত দিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি-শিল্প মালিকরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন।

সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এ দেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন, আন্দোলন কিভাবে করতে হয় আমি জানি।

কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকহলের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোন বাঙ্গালী রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না।

শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃংখলা বজায় রাখুন। শৃংখলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না।

আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।

এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা।"